বর্তমান বিজ্ঞানের যে বিষয়টি পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের গলার কাঁটা হয়ে বিঁধে আছেতা নিঃসন্দেহে বিবর্তনবাদ।
বর্তমান বিজ্ঞানের যে বিষয়টি পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের গলার কাঁটা হয়ে বিঁধে আছে তা নিঃসন্দেহে বিবর্তনবাদ। এবং সভ্যতার স্বাভাবিক নিয়মানুসারেই মানুষ একসময় এটাকে স্বীকার করে নিতে বাধ্য হবে। কিংবা বিবর্তনবাদ ছাড়া যদি জীবের ক্রমবিকাশের নতুন কোনো থিয়োরীও আসে সেটা অবশ্যই বিবর্তনবাদেরই আরো স্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা হবে। নিশ্চয় আকাশ থেকে কথা নাই বার্তা নাই, ধপাস করে বৃষ্টির মত বাঘ ভাল্লুক পশু পক্ষী গাছ পালা পৃথিবীতে এসে পড়েছে, এই ধরণের তত্ত্ব বিজ্ঞান স্বীকার করে নিবেনা। বাস্তব জীবনে অনেককেই দেখেছি দাবী করে, বিবর্তনবাদ সে বিশ্বাস করেনা। কেবল বিবর্তনবাদ নয়, মূলত বিজ্ঞানের কোনো থিয়োরীই বিশ্বাস অবিশ্বাসের সাথে সম্পর্কিত নয়। প্রশ্নটা হচ্ছে, সে বিবর্তনবাদ বুঝে নাকি বুঝেনা। ধরুণ আপনাকে কেউ একজন এসে বললো, ভাই আমি ডেইলি একটা করে ডিম পাড়ি। আপনি ভালো করে খেয়াল করে দেখলেন যে এই ছোকরাটা একটা জলজ্যান্ত মানুষ, সে মৎস, পাখি কিংবা সরীসৃপ নয়। আপনি তাকে বুঝিয়ে বললেন, সেটা মনের ভুল, সে কিছুতেই ডিম পাড়তে পারেনা। সে চাদরের নিচ থেকে একটা চাপাতি বের করে আপনাকে অশ্রাব্য ভাষায় দুইটা গালি দিয়ে কোপানো শুরু করতে পারে। ব্যাপারটা এতটাই তুচ্ছ। শুধু পারস্পেকটিভ ভিন্ন।
.
আমাকে যদি প্রশ্ন করা হয়, আমি ঠিক কোন জিনিসটা দেখে বিবর্তনবাদকে স্বীকার করে নিয়েছি এবং ভালো করে বিজ্ঞানের এই অত্যাশ্চর্য প্রক্রিয়াটি বুঝার জন্য উঠে পড়ে লেগেছি। তাহলে আমি প্রথমেই উত্তর দেবো, বিবর্তনবাদ নিয়ে কোনো কঠিন বই পড়ার মাধ্যমে কিংবা কারো প্ররোচনায় আমি এর প্রতি আগ্রহী হইনি। আপনার প্রথমেই যেটা লাগবে সেটা হচ্ছে খুব পরিষ্কারভাবে চিন্তা করা এবং সিদ্ধান্ত নেয়ার সাহস। বিজ্ঞানের সমস্ত রস গলাধঃকরণ করতে প্রথমেই কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করে গাদা গাদা বই কেনার প্রয়োজন নেই। প্রথমেই বলবো, সাহস সঞ্চয় করুন। যদি কোনো থিয়োরী আপনার প্রচলিত মতাদর্শের বিরুদ্ধেও যায়, সেটাকে কতটা পজিটিভলি নিতে পারবেন ভেবে দেখুন। যদি দেখেন, আপনি মেনে নিতে পারবেন না কিছুতেই। তাহলে দয়া করে বই গুলো খুলেও দেখবেন না। আগে নিজের মনকে শান্ত করুন, সাহস সঞ্চয় করুন। এটা করতেই জীবনের দীর্ঘ একটা সময় লেগে যায় অনেক মানুষেরই। একবার যদি এই সাহসটা অর্জন করতে পারেন, পৃথিবীর যেকোনো সত্যের মুখোমুখি আপনি দাঁড়াতে পারবেন সেটা যতই নির্মম হোকনা কেন।
.
সাহস তো সঞ্চয় করে নিলেন। এইবার? এইবার নিজেকে প্রশ্ন করুন, পৃথিবীতে এত হাজার হাজার প্রজাতি কিভাবে এলো। কোনো একটা বিজ্ঞানসম্মত উপায় তো থাকবেই। নিজে নিজে কোনো একটা থিয়োরি বানাতে চেষ্টা করুন যেটা অন্তত কিছুটা বিজ্ঞানের ধারে কাছে যায়। হোক সেটা ভুল। কিন্তু সত্য একেবারে ধরা দেয়না। আপনার ভুলটাকে ইনভার্স করলে যা পাবেন সেটাই সত্য। অতএব নিজে নিজে ভাবুন। যেমন আমি ধরে নিয়েছিলাম, আকাশ থেকে তো আর এত লক্ষ কোটি প্রজাতি হাজির হবেনা, অতএব নিশ্চয় প্রথমে একটাই প্রজাতি সৃষ্টি হয়েছে সামহাও। এরপর তাদের মিলনে অন্য প্রজাতির সৃষ্টি। হ্যাঁ, এটা আমার ভুল ধারণা ছিলো। কিন্তু অন্তত বিজ্ঞানের “অনুসন্ধান” এর প্রয়োজনীয়তাকে এটি ফুলফিল করেছিলো। অন্তত এই ধারণাটা কিছুটা হলেও বৈজ্ঞানিক ছিলো! আপনি যদি এই লেভেল পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেন, তাহলে বুঝে নিবেন আপনি প্রস্তুত! সমস্ত দ্বন্দ্বের ঊর্ধ্বে উঠে এবার ধীরে ধীরে বিবর্তনবাদকে জানার চেষ্টা করুন! আর নিজেকে প্রশ্ন করুন। কেবল বিবর্তনবাদ নয়। জীবনের যেকোনো কাজেই এই সাহস ও অনুসন্ধিৎসু মনটা প্রচুর দরকার। এটা না হলে সভ্যতার দৌড়ে আপনি পিছিয়ে পড়বেন।
.
আচ্ছা, এইবার আমাকে যদি প্রশ্ন করেন, কোনটাকে বিবর্তনবাদের সবচেয়ে বড় প্রমাণ বলে মনে করি, আমি বলবো “নিউক্লিক এসিড ভিত্তিক প্রাণ প্রণালি!” একটু ব্যাখ্যা করি। পৃথিবীতে দুইরকমের জীবকোষ আছে। একটা ইউক্যারিওটিক আরেকটা প্রোক্যারিওটিক। ক্যারিওটিক মানে নিউক্লিয়াসযুক্ত। প্রো মানে আদি। মানে, আদি নিউক্লিয়াস যুক্ত কোষ বা আদি কোষ। এবং অন্যটি প্রকৃত কোষ। এই দুইটি কোষের মাঝে প্রোক্যারিওটিক কোষ সুগঠিত নয়। এতে কোষীয় অঙ্গানু হিসেবে কেবল রাইবোসোম থাকে। এই রাইবোসোম থাকে বলেই তারা প্রোটিন সংশ্লেষের কাজটা অন্তত করতে পারে। এবং তাদের ক্রোমাটিন বডিতে DNA থাকে। অন্যদিকে প্রকৃত কোষে রাইবোসোমের পাশাপাশি অন্যান্য সব অঙ্গাণুই থাকে। তাহলে স্পষ্টতই বুঝতে পারছেন জীবন গঠনের একেবারে মৌলিক একটি উপাদান এই নিউক্লিক এসিড দিয়ে পৃথিবীর সমস্ত কোষদেহ তথা জীবদেহ গঠিত। ঠান্ডা মাথায় ভাবলে এটিই জীব বিবর্তনের সবচেয়ে বড় প্রমাণ।
.
পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টি কিভাবে হয়েছিলো সেই ব্যাখ্যা বিবর্তনবাদ দেয়না। বিবর্তনবাদ প্রাণের বিকাশ ও প্রজাতির উদ্ভব নিয়ে আলোচনা করে। প্রাণ সৃষ্টির সময় সেই সময়ের পরিবেশে হয়তো কয়েকপ্রকার জীবের উদ্ভব ঘটেছিলো, আমরা নিশ্চিত নই। ঘটে যাওয়াই উচিত। বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের পারমুটেশান কম্বিনেশান কয়েক রকমের প্রাণ সৃষ্টি অসম্ভব কিছু নয়। কার্বনের সাথে হয়তো সিলিকন ভিত্তিক প্রাণও সৃষ্টি হয়েছিলো কে জানে। কিন্তু টিকে আছে কেবল কার্বনই। পৃথিবীতে প্রাণের একটি ও কেবলমাত্র একটি সিস্টেম টিকে আছে। অন্য কোনো সিস্টেম পৃথিবীতে নেই। প্রাণ সৃষ্টির শুরুতে থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু বর্তমান পৃথিবীতে আমরা কার্বন ছাড়া সিলিকন বা অন্য কোনো ক্যাটেনেশান ধর্মযুক্ত মৌলভিত্তিক প্রাণ খুঁজে পাইনি। পৃথিবীর বাইরে যদি আমরা প্রাণের অস্তিত্ব পাই, সেই প্রাণের বৈশিষ্ট্য যে আমাদের পৃথিবীর মত হবে তার কোনো সম্ভাবনাই নেই। সেই প্রাণের বৈশিষ্ট্য গুলো অবশ্যই আমাদের চেনা পরিচিত হবেনা। সেই প্রাণে কার্বনভিত্তিক নিউক্লিক এসিড থাকবেনা। কী থাকবে সেটা আমরা নিশ্চিত জানিনা। এমনকি পৃথিবীতে আমরা যে মৌলিক পদার্থগুলো খুঁজে পেয়েছি, অন্য গ্রহে সেই সব মৌলের সবগুলোর অস্তিত্ব নাও থাকতে পারে, কিংবা সেইসব গ্রহে এমন কোনো মৌল থাকতে পারে যার সম্পর্কে পৃথিবী বাসির বিন্দুমাত্র আইডিয়াও নেই। কারণ, মহাবিশ্বে গ্রহ সৃষ্টির প্রারম্ভে সারা মহাবিশ্বব্যাপী পরিবেশ নিশ্চই একই রকম ছিলোনা। সকল নক্ষত্রগুলোর ফিউশনিত হাইড্রোজেন হিলিয়ামের অনুপাতও নিশ্চয় একই হবেনা। তার মানে আমরা যা বলতে পারি নিশ্চিতকরে, সেটা কেবল আমাদের পৃথিবীর রেফারেন্সেই বলা সম্ভব, এবং আমাদের পৃথিবীর পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলোকে মহাবিশ্বের জন্য ধ্রুব ধরে নিয়ে সেইসবের একটা আপাত ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব। এটুকুই আমরা পারি। এর বেশি নয়।
.
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, পৃথিবীতে সকল জীবই কার্বন তথা নিউক্লিক এসিড ভিত্তিক প্রাণধারী কেন? আপনার বাসায় সেমাই, পায়েস, কাস্টার্ড ইত্যাদি নাস্তা প্রস্তুত করা হলো এবং আপনার বাসায় একটা এবং কেবলমাত্র একটাই দুধের কৌটা। বহির্বিশ্বের সাথে আপনার বাসার কোনো সংযোগই নেই। কমনসেন্স থাকলে আপনি এই অনুসিদ্ধান্তেই আসবেন, আর তা হচ্ছে এইসব দুগ্ধজাত মিষ্টান্ন ঐ দুধের কৌটার দুধ ব্যবহার করেই তৈরী হয়েছে। ঠিক অনুরূপভাবে, সারা পৃথিবীর সমস্ত জীব তন্নতন্ন করে খুঁজে আপনি আবিষ্কার করলেন সমস্ত জীবেই নিউক্লিক এসিড রয়েছে। এবং এই জীব গুলো পৃথিবীতে অন্যগ্রহ থেকে রকেটে করে আসেনি। তাহলে কমনসেন্স থেকেই আপনার এই অনুসিদ্ধান্তে আসা উচিত যে, সমস্ত জীবই বিকশিত হয়েছে একটি সরল নিউক্লিক চেইন থেকে। এই নিউক্লিক চেইনটি হচ্ছে রাইবো নিউক্লিক এসিড কিংবা RNA যেটা এখন পর্যন্ত সবচেয়ে সরল স্বীকৃত নিউক্লিক এসিড। বিজ্ঞানীরা অবশ্য সাম্প্রতিক গবেষণায় আরো সরল একটা নিউক্লিক এসিড সৃষ্টির অ্যাজাম্পশান করেছেন আর নাম দিয়েছেন XNA. সেটার বিস্তারিত না জানলেও সমস্যা নেই। পরে হয়তো আরো সরল নিউক্লিক এসিডের সন্ধান পাওয়া যাবে। আমরা যা জানি তা হচ্ছে সমস্ত জীবের উৎপত্তির জন্য দায়ী হচ্ছে একটি সহজ সরল নিউক্লিক এসিডের চেইন। এবং এটিই পর্যায়ক্রমে জটিল থেকে জটিলতর থেকে আরো জটিলতর হয়েছে।